ড. মাহফুজ পারভেজ:
শেষ শাসকের ভাগ্য সব সময়ই বেদনাব্যঞ্জক। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, প্রাচীন বাংলার সেন আমলের শেষ শাসক লক্ষ্মণ সেন, এমনকি বাংলার শেষ স্বাধীন নৃপতি সিরাজ-উদ-দৌলাহ ছিলেন চরমভাবে ভাগ্য বিড়ম্বিত। দুনিয়া কাঁপানো লাল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পীঠস্থান অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভও (২ মার্চ ১৯৩১ – ৩০ আগস্ট ২০২২) বরণ করেন অভিন্ন ভাগ্যলিখন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের শেষ মুঘল হয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার তিন যুগ পর তিনি জীবন থেকেও চিরবিদায় গ্রহণ করলেন।
গর্বাচেভ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রধান নেতার পদে আসেন পূর্ববর্তী কনস্তান্তিন চেরনেনকোর মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালে। তিনি ক্ষমতায় এসে দেশ শাসনকারী সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান নেতা নিযুক্ত হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজমের পতনকালে তিনি ছিলেন মূল আলোচিত চরিত্র। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েতের ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির দিন তিনি পদত্যাগ করেন। গর্বাচেভের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বিশ্বে চার দশক ধরে চলা স্নায়ুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
তিনি ছিলেন ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’ নীতির প্রবর্তক, যে মুক্ত জানালা ও খোলা নীতির তোড়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক শাসনের সৌধ ভাসিয়ে দেয়। সমাজতন্ত্র প্রভাবিত দেশগুলোও একের পর এক গণতান্ত্রিক শাসনবিধিকে আলিঙ্গন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বরাজনীতিতে আমূল পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। আমেরিকার ও সোভিয়েতের নেতৃত্বে দ্বিমেরু ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থারও অবসান হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতার স্বীকৃতিতে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র নিয়ে “স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রমণ্ডল” বা ‘কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস’ (সিআইএস) নামক একটি অবিভক্ত অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন তৈরি হয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অষ্টম ও চূড়ান্ত নেতা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ পদত্যাগ করেন।
তার পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং সোভিয়েত পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য কোডগুলো নিয়ন্ত্রণসহ রাশিয়ার নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই দিন সন্ধ্যা ৭:২৩ মিনিটে সোভিয়েত পতাকা সোভিয়েত শাসনকেন্দ্র ক্রেমলিনের থেকে নেমে বিপ্লবী রাশিয়ার প্রাক্তন পতাকায় প্রতিস্থাপিত হয়।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত পতনের আগেই আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সমস্ত স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্র, রাশিয়া সহ, সোভিয়েত ঐকতন্ত্র থেকে সরে যায়। ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির এক সপ্তাহ আগে, ১১ প্রজাতন্ত্রের স্বাক্ষরিত আলম-আতা প্রোটোকল আনুষ্ঠানিকভাবে সিআইএস প্রতিষ্ঠা করে এবং ঘোষণা করে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে। ১৯৮৯ সালের বিপ্লব এবং ইউএসএসআর বিলোপ শীতল যুদ্ধ শেষেরও ইঙ্গিত দেয়।
সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বেশ কয়েকটি দেশ বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং স্বাধীন ও কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস, ইউরেশীয় ইকোনোমিক কমিউনিটি, ইউনিয়ন স্টেট, ইউরেশীয় কাস্টমস ইউনিয়ন এবং ইউরেশীয় ইকোনমিক ইউনিয়নের মতো বহুজাতিক সংস্থা গঠন করেছে, যা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অন্য দিকে, শুধুমাত্র বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করেছে।
২০১৪ সালের পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, ৫৭ শতাংশ নাগরিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, আর ৩০ শতাংশ বলেছে তারা তা করেনি। বয়স্ক মানুষ ছোট রাশিয়ানদের তুলনায় আরো নস্টালজিকপ্রবণ। ইউক্রেনের ৫০% উত্তরদাতারা ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুরূপ একটি জরিপে অংশগ্রহণ করে বলেছে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। ২০০৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন লেনিনকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্রের ‘রাজনৈতিক সেকেন্ডের অধিকার’ সম্পর্কে তার বক্তব্যকে দায়ী করেছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ফলে সোভিয়েত রাষ্ট্র ও পূর্ব পূর্ব ব্লকের জীবনযাত্রার মানসিক বিপর্যয়ের একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট ও বিপর্যয়কর পতন ঘটে, যা গ্রেট ডিপ্রেসনের চেয়েও খারাপ ছিল। তবে বর্তমান রুশ নেতা পুতিন কমিউনিস্ট-পূর্ব সাবেক শাসক ‘জার’দের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে দেশটিকে আবার বিশ্বরাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত অবস্থানে নিয়ে এসেছেন।
একসময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিল মূলত সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত নেতা হিসেবে তার প্রায় সাড়ে ছয় বছরের শাসনামলে যে বিপুল পরিমাণে সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন তার কারণে। তার করা সংস্কারগুলোকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৫ সালের ১১ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আরোহণ করেন মিখাইল গর্বাচেভ। ইতোমধ্যে সোভিয়েত জনগণ কমিউনিস্টদের অত্যাচার, নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।
নতুন নেতা গর্বাচেভ অন্যান্য সোভিয়েত শাসকদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি গতানুগতিক সোভিয়েত ধারার বাইরে গিয়ে নতুনভাবে ইউনিয়নকে সাজাতে চেয়েছিলেন।
গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৮৬ সালে গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) এবং পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) নীতি গ্রহণ করেন। গ্লাসনস্ত অনুযায়ী সোভিয়েতরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়। প্রায় সাত দশকের সোভিয়েত শাসনে নাগরিকরা যে স্বাধীনতাহীনতায় ভুগেছে তার অবসান ঘটে। মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ও মুক্ত আলোচনার অধিকার পায়। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রের অবসানের মাধ্যমে নাগরিকদের ভোটাধিকার ও কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে গিয়ে দল গঠন ও নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর পেরেস্ত্রোইকা অনুযায়ী ভঙ্গুর সোভিয়েত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা করা হয়। নতুন নীতি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনেকটা বর্তমান চীনের মতো ক্যাপিটালিজম এবং কমিউনিজমের সংমিশ্রণে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ছিল তা অবসানের পরিকল্পনা করা হয়।
নতুন নীতিদ্বয়ের মাধ্যমে গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সার্বজনীন ভোটাধিকার, গণতন্ত্রীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই নীতিগুলোর ফলে মানুষ খাঁচা থেকে মুক্ত পাখির মতো উড়তে থাকে। প্রায় সাত দশক ধরে চলা কমিউনিস্ট নির্যাতন থেকে চিরস্থায়ীভাবে বাঁচার প্রয়াস পায় তারা। এর ফলে নাগরিকরা উন্নত জীবনযাপন, আরো স্বাধীনতা ও কমিউনিজমের অবসানের পথ উন্মুক্ত হয়।
গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত গর্বাচেভের সংস্কারগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার বদলে ধ্বংস করে দেয়। গর্বাচেভের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে স্নায়ুযুদ্ধের শীতল সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা আসে। স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্তিতে তার উদ্যোগের স্বীকৃতি সরূপ ১৯৮৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন গর্বাচেভকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ মনোনীত করে। পরের বছর টাইম ম্যাগাজিন গর্বাচেভকে ‘দশকের সেরা ব্যক্তি’ হিসেবে মনোনীত করে। ১৯৯০ সালে গর্বাচেভ ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন।
গর্বাচেভ ছিলেন ‘ভিকটিম অব দ্য সিচুয়েশন’। পরিস্থিতির ‘বলির পাঁঠা’ হতে হয়েছে তাকে। ইতিহাসের ঘোরতর সন্ধিকালে সর্বশক্তি ও সর্বকৌশল প্রয়োগ করেছিলেন তিনি সমাজতন্ত্রে লাল স্বপ্নকে রক্ষা করতে। কিন্তু ততক্ষণে পুরো দৃশ্যপটই বদলে গিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কোটি কোটি জনতা লালঝাণ্ডা ফেলে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় শামিল হয়েছিল। পোলান্ডে, গদানস্কে, বেলগ্রেডে, সোফিয়ায়, প্রাগে মানুষ নিজ দেশের জাতীয় অস্তিত্বের মোহনায় সমবেত হন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে। চোখের সামনে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শাসনকাঠামো ভেঙে পড়ে। ১৯৮৯ সালে পতন হয় বার্লিন প্রাচীরের। কিন্তু তখনও পর্যন্ত টিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মিখাইল গর্বাচেভ।
কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। তারা গর্বাচেভের গৃহীত উদারপন্থী কর্মসূচি ‘গ্লাসনস্ত-পেরস্ত্রইকার’ ব্যাপারে খুশি ছিলেন না। সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় গর্বাচেভ বেঁচে গেলেন ঠিকই, কিন্তু নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। কারণ ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই তখন পূর্ব ইউরোপের গণতন্ত্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে। সর্বত্র স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
এমন একটি নাজুক ও বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে টিকে থাকা গর্বাচেভ কেন, কোনো শাসকের পক্ষেই প্রায়-অসম্ভব বিষয়। গর্বাচেভও ব্যর্থ হন। কিন্তু তীব্র রাজনৈতিক পাললাবদলের ফলে সংঘাত ও রক্তপাতের বিষয়গুলো যতদূর সম্ভব ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। জনপ্রত্যাশার প্রতি নমনীয় হয়ে নিজে ক্ষমতা থেকে সরেও গিয়েছিল। তিনি অবশ্যই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে থাকবেন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের শেষ মুঘল নামে পতনের জন্য সমালোচিত হলেও তিনিই আবার রুশদেশে গণতন্ত্রের পথ খুলে দেওয়ার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়।
সংগ্রহ:
ড. মাহফুজ পারভেজ, লেখক-বিশ্লেষক