মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বিশেষ প্রতিবেদক।।
সিঙ্গাপুর ভিত্তিক পিএসআই (প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন) কোম্পানি সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড এর সাথে বাংলাদেশ রেলওয়ের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দফতরের কর্মকর্তাদের গভীর খাতিরের তথ্য মিলেছে। এই কোম্পানির হাত দিয়ে চলছে একের পর এক বৈদেশিক কেনাকাটা। তাও আবার কোনোরকম দরপত্র ছাড়াই।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ক্রয়ের এক দরপত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ের সরঞ্জাম ক্রয় নিয়ন্ত্রক দফতরে ঠাঁই নেওয়ার পর আর কোনো কেনাকাটায় দরপত্র দিতে হয়নি এই কোম্পানিকে। রেলওয়ের সাধু সন্যাসীরা এই এক দরপত্রের মেয়াদ বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক কেনাকাটার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর মদদ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেসমিন আক্তার, সহকারী পরিচালক, দুদক প্রধান কার্যালয়
অভিযোগের তথ্যমতে, ২০২১ সালে হুন্দাই কোরিয়ার সরবরাহ করা দশটি লোকোমোটিভে কারিগরি ত্রুটি থাকার পরও রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে ছাড়পত্র পায়। এই লোকমোটিভগুলো ক্রয়ে জড়িত ছিল সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড। দেশে আসার পর লোকোমোটিভগুলোর ক্রটি সবার নজরে আসে। দুর্নীতির এমন নজির রেলওয়েতে আর ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, পিএসআই কোম্পানি নিয়োগের ক্ষেত্রে রেলওয়েতে বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা এর আগে আর কখনো ঘটেনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও তার সহযোগীরা এ ধরনের কোম্পানি নিয়োগের সাথে জড়িত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, লোকোমাটিভ ক্রয়ে অনিয়মের বিষয়টি করোনা মহামারীর সময়ের ঘটনা। ওই সময় দরপত্র ছাড়া পিএসআই কোম্পানির মেয়াদ বাড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল। যা বাংলাদেশ রেলওয়ের আইনসিদ্ধ। রেলওয়ের বিধি মোতাবেক ওই কোম্পানির মাধ্যমে কেনাকাটা হয়েছে। এতে কোনো দূর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি।
সূত্র জানায়, সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি বাংলাদেশ রেলওয়ের সরঞ্জাম ক্রয় দফতরে পিএসআই কোম্পানি হিসেবে কাজ করছে। এই কোম্পানির সাথে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৮ সালে আগস্ট মাসে তিন বছর মেয়াদী চুক্তি সম্পন্ন করে। চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালের আগস্ট মাসে শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো প্রকার দরপত্র ছাড়াই চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে।
২০২১ সালের অক্টোবর বাংলাদেশ রেলওয়ে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট বা ইওআই প্রকাশ করে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখে মোট ছয়টি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের প্রাথমিক প্রস্তাব জমা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে মূল্যায়নের নামে কালক্ষেপণ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দরপত্র বিষয়ক কার্যক্রম স্থগিত রেখে সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড এর সাথে শেষ হয়ে যাওয়া চুক্তিটি গোপন অন্যায়ভাবে বর্ধিত করতে থাকে।
এরপর আগের এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট বাতিল করে ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার নতুনভাবে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট প্রকাশ করে। এবার মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক প্রস্তাব দাখিল করে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে ২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রস্তাব মূল্যায়ন করতে তাদের কালক্ষেপন চলমান রাখে। এর ফলে আবারো ওই কোম্পানির সাথে চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশে যখন রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তন হচ্ছিল এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা যখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত এরকম একটি গোলকধাঁধার সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাড়াহুড়ো করে এই অনৈতিক কাজটিকে নৈতিকতা দান করে এবং তারা দুইটি কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করে তাদের থেকে টেকনিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল প্রস্তাব আহ্বান করে।
সূত্রের দাবি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী আওয়ামী মন্ত্রীর সাথে ওই কোম্পানিটির আর্থিক যোগসাজসের কারণে দরপত্র ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়। সরকারের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে রেলওয়ে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দরপত্র মূল্যায়নের দীর্ঘসূত্রিতা ও তাদেরই আগের মনোনয়নকৃত প্রতিষ্ঠানকে বাতিল করেছে।
এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনিয়মের ঘটনাও ঘটেছে। হুন্দাই কোরিয়ার সরবরাহ করা দশটি লোকোমোটিভে কারিগরি ত্রুটি থাকার পরও পিএসআই কোম্পানি রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে লোকমোটিভগুলো ছাড়পত্র দিয়েছে। এই লোকমোটিভগুলো দেশে আসার পর ক্রটি সবার নজরে আসে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পিএসআই কোম্পানি নিজেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে রেলওয়েকে বিরত রাখে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত হওয়া ১০টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কেনায় দুর্নীতি ও অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগ যাচাইয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুন) রেল ভবনে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার জানান, বাংলাদেশ রেলওয়েকে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি। দাম ছিল ৩২২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। চুক্তিতে তিন হাজার হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দেওয়ার কথা থাকলেও দুই হাজার হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে এছাড়া আরও কিছু অনিয়মের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে টিম।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন বা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশান (পিএসআই) এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মালামালের গুণগত মান ও পরিমান স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহকারী প্রদান করছে কিনা তা দেখা ও কোনও অসঙ্গতি থাকলে তা ক্রয়কারীকে জানানো। কিন্তু পিএসআই প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভয়ে সে তথ্য গোপন করে গেছে। একের পর এক শতকোটি টাকার ক্রয় কার্যাদেশ বাগিয়ে নিয়েছে সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও ক্রয় কার্যাদেশ বাগিয়ে নেওয়ার কাজে তৎপর রয়েছে ওই কোম্পানি।