মুহাম্মদ মহিউদ্দিন।।
ট্রেনের ভুয়া মাইলেজ বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু কর্মচারীরা। এসব কাজের নেপথ্যের কারিগর
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) কার্যালয়ের স্টোনো (সদ্য বদলিপ্রাপ্ত) গোলাম কিবরিয়া।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের সিআরবি পাওয়ার কট্রোল (সিপিএনএল) অফিসে গত ২০ বছর ধরে কাজ করছেন ট্রেনচালক মো. নজরুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান। সেখানে আছেন ট্রেনচালক সুমন চক্রবর্তীও। পাহাড়তলী লোকেশেডে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এসএম শাহেদ আলী। খোরশেদ আলম ও মো. হানিফ আছেন শেডম্যান হিসেবে।
কিন্তু তারা কোনোদিন ট্রেন চালাননি। ট্রেন না চালিয়েই তারা তোলেন মাইলেজ। তাদের মতো রেলওয়ে চট্টগ্রামে ট্রেনচালক ও সহকারী ট্রেনচালক হিসেবে আছেন ২০ থেকে ৩০ জন। তারাও ‘তদবিরের মাধ্যমে’ বিভিন্ন দপ্তরের বিভিন্ন পদে কাজ করে যাচ্ছেন। আর ট্রেন না চালিয়ে প্রতিমাসে ভুয়া মাইলেজ দেখিয়ে তুলছেন হাজার হাজার টাকা।
মাইলেজ বানানোর কারিগর হিসেবে কাজ করছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) কার্যালয়ের স্টোনো (সদ্য বদলিপ্রাপ্ত) গোলাম কিবরিয়া। যার পকেটে ঢুকে এই ভুয়া মাইলেজের তোলা অর্ধেক টাকা। আবার ভুয়া ট্রেন চালকের মাইলেজ দেখিয়ে পুরো টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া রেলকর্মীদের বাৎসরিক ইউনিফর্ম, টুপি, জুতা, টর্চলাইটের টাকা আত্নসাৎসহ বিভিন্নকাজের ফাইল ছাড়া এবং সম্প্রতি আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিকদের ভাল জায়গায় পোস্টিংয়ের নামে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, এস্টেট শাখায় বদলি করা হলেও গোলাম কিবরিয়া ডিসিও শাখায় সেই পূরনো চেয়ারে বসেই কাজ করছেন নিত্যদিন। এস্টেট শাখায় তিনি কাজ করেন খুবই কম। এস্টেট শাখার বড় বাবু ইশতিয়াক আহমেদ এ নিয়ে ক্ষোভ ঝারলেও কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।,
এদিকে চালক সংকটের কারণে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ ট্রেন পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা। এজন্য ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে রানিং স্টাফদের অন্য অফিসে কাজ করা নিষিদ্ধও করা হয়েছে। কিন্তু কার কথা কে মানে। যেখানে টু-পাইসের সুবিধা সেখানে নানা অজুহাতে কাজ করছেন রেলওয়ের সুবিধাবাদী কর্মীরা। এ নিয়ে জোর গলায় কথা বলারও মুরোদ নেই রেলওয়ে কর্মকর্তাদের। কারণ তাদের নানা অনিয়ম-দূর্নীতির সাথী রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির এসব অসাধু কর্মচারী।
কর্মচারীরা জানান, ভুয়া মাইলেজ, রেলকর্মীদের ইউনিফর্ম, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের পোস্টিংসহ নানা কাজে অনিয়ম-দূর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা গোলাম কিবরিয়ার মাধ্যমে ডিসিও-ডিটিও, সিসিএমসহ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটেও যায়। যার কারণে রেলওয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অনিয়ম-দূর্নীতি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেন না কর্মকর্তারা।
ট্রেনচালকদের বিভিন্ন অফিসের কাজের দায়িত্বে থাকা ও ভুয়া মাইলেজ নিয়ে কথা বলতে গিয়েও এর সত্যতা মিলে কয়েকজন কর্মকর্তার মুখে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, রানিং স্টাফদের অফিসে কাজ করা অবৈধ নয়। জনবল সংকটের কারণে হয়তো বিভিন্ন দপ্তরে অনেকে কাজ করেন।
গত ৯ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের আদেশে রানিং স্টাফদের অন্য অফিসে কাজ করার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সচিব মহোদয়ের আদেশ নিয়ে কাজ করছি। ভুয়া মাইলেজ তুলে নেওয়া ও অফিসে রানিং স্টাফের কাজের বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তার।
এ বিষয়ে গোলাম কিবরিয়া বলেন, মাইলেজের হিসাব নিয়ে কাজ করার মতো ডিসিও অফিসে আর কেউ নেই। তাই ডিসিও ম্যাডাম আমাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। আর ভুয়া মাইলেজ দেখিয়ে আমরা কত টাকা পায়। যা পায় তা তো আমি একা খাই না। সংশ্লিষ্ট সবার ভাগে যায়। আর ছোটখাট বিষয়গুলোতে আপনাদের চোখ পড়ে, রাঘব বোয়ালদের দিকে চোখ পড়ে না। ক্ষিপ্ত হয়ে এসব কথা বলেন গোলাম কিবরিয়া।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) তৌষিয়া আহমেদ ডিটিও আনিসুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাদের কেউ কল রিসিভ করেননি। ফলে তাদের কারও বক্তব্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তথ্যমতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ১০ জন ট্রেনচালক, ১০ জন সহকারী ট্রেনচালক ও ৬ জন সাব ট্রেনচালক চট্টগ্রামের সিআরবি ও পাহাড়তলীর বিভিন্ন দপ্তরে বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। প্রতিমাসে বেতনের সঙ্গে অবৈধভাবে ৫০-৬০ হাজার টাকা মাইলেজও তুলে নেন তারা।
তেমনই একজন ট্রেনচালক সুমন রঞ্জন দাশ। পাহাড়তলী বিভাগীয় প্রকৌশল বিভাগে (ডিএমই অফিস) ১৮ বছর ধরে করণিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখান অফিসে গড়ে তুলেছিলেন ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট। নিজেও বেনামে ঠিকাদারি করতেন। গত ৯ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের আদেশের পর তাকে সরানো হয় বিভাগীয় প্রকৌশল অফিস থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, অন্যের নামে লাইসেন্স নিয়ে ঠিকাদারি করেন তিনি। বিভাগীয় অফিসের কেনাকাটা ও মালামাল সরবরাহ করে কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর জামালখান এলাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট। পাহাড়তলী এলাকায় কিনেছেন আড়াই কাঠার একটি প্লটও। সুমন রঞ্জন তার দুর্নীতিতে সহায়তার জন্য আপন বোনকে খালাসি পদ থেকে প্রকৌশল বিভাগে নিয়ে আসেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুমন রঞ্জন দাশ বলেন, আমার পেছনে লোক লেগেছে। তারা এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াচ্ছে। আমি বিভাগীয় প্রকৌশল বিভাগে কাজ করেছি, তবে কোনো দুর্নীতি করিনি৷ আমার কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নেই। চাইলে যে কেউ তদন্ত করে দেখতে পারে৷
এছাড়া পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করেন অঞ্জন কান্তি বিশ্রাঙ্গী, পাহাড়তলী পাওয়ার কন্ট্রোলে (পিএনএল) কাজ করেন মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া। পাহাড়তলী লোকেশেডে ১০ বছর ধরে পুশিংয়ের কাজ করছেন ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার) গোলাম শাহরিয়ার।
সহকারী চালকদের (এএলএম) মধ্যে পাহাড়তলী পাওয়ার কন্ট্রোল অফিসে আছেন শাহেদুল ইসলাম, শুভ রায়। পাহাড়তলী লোকোশেড আমতলা অফিসে করণিক হিসেবে কাজ করেন রেহানা আবেদিন, কুলসুমা আকতার, খুরশীদা আকতার, সালমা বেগম, উম্মে সালমা সিদ্দিকা, সাজেদা খানম, কোহিনূর আকতার। শাহাদাত হোসেন খন্দকার চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে জুনিয়র লোকো ইন্সপেক্টর (জেএলআই) হিসেবে কাজ করেন।
সহকারী ট্রেনচালক মনিরুল ইসলাম চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেনারেল বুকিং ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। স্টেশনে নির্ধারিত জেনারেল বুকিং ক্লার্ক থাকার পরও তিনি ওখানে কাজ করেন। সিআরবি কন্ট্রোল অফিসে কাজ করেন মো. ইকবাল চৌধুরী ও আহসান হাবিব। হাবিব উল্লাহ বেলালী, জাহেদুল ইসলাম চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে জেএলআই হিসেবে কাজ করেন। এর মধ্যে কন্ট্রোল অফিস মো. মিজানুর রহমান ২০১৮ সালে এএলএম থেকে এসএলএম হন।
এসব ট্রেনচালক ও সহকারী চালকদের ট্রেন চালানোর দায়িত্বে থাকার কথা হলেও তারা তদবিরের মাধ্যমে পড়ে আছেন বিভিন্ন দপ্তরে৷ তারা কোনদিন ট্রেন চালিয়েও তুলে নিচ্ছেন ভুয়া মাইলেজের টাকা