দখলে ইন্ধন দিয়ে টাকা আদায়, আবার দখল উচ্ছেদের হুমকি দিয়েও চলছে টাকা আদায়। এভাবে বাণিজ্য চলছে বসতির ক্ষেত্রে। এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা ও ভাড়া বাণিজ্য চলছে অবৈধ দোকান ও মার্কেট নির্মাণের ক্ষেত্রে। ইজারার ক্ষেত্রেও থেমে নেই টাকা আদায়।
ইজারা নিয়ম মেনে এক খাতে ইজারা দেখিয়ে নানাভাবে জালিয়াতি করে অন্যখাতে স্থাপনা গড়ার ক্ষেত্রেও লুটে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে এসব অপকর্মের সাথে জড়িত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি বিভাগের অঘোষিত জমিদার বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তা দিপঙ্কর তঞ্চ্যাঙ্গা, আমিন আবদুস সালাম ও গোলাম কিবরিয়া চক্র।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুসন্ধানের জানা যায় , রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও ঢাকা অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মার্কেট গড়ে তোলে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা চালাচ্ছেন প্রভাবশালীরা।
এসব অবৈধ স্থাপনার অধিকাংশের মালিক রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। এর বাইরে যারা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তাতেও মূল ইন্ধনে রয়েছেন বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি বিভাগের এই চক্র। যারা হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ-লাখ টাকা। আবার কোন কর্মকর্তা-কর্মচারির সাথে আরেক কর্মকর্তা-কর্মচারির আভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেও চলে দখল উচ্ছেদের হুমকি। যা লাখ টাকার কমে ছাড়া হয় না। নতুবা উচ্ছেদ করে ছাড়ে বিরোধকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারির স্থাপনা।
বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি দপ্তরের সার্ভেয়ার আবদুস সালামের ক্যারিসমেটিকে চলে দখল ও উচ্ছেদ বাণিজ্য।
এছাড়া রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত যত রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে, সবগুলোর চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার অবৈধ দোকানপাট ও মার্কেট ভবন। যা স্থাপনেও আদায় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। আবার টাকা আদায় থেমে নেই ইজারাকৃত জমির উপর স্থাপনা নির্মাণেও। কারণ ইজারা দেওয়া জমির অধিকাংশই ইজারা শর্ত না মেনে গড়ে তোলেছেন বাণিজ্যিক স্থাপনা। যার সাথে গোপন চুক্তিতে রয়েছে বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি বিভাগের চক্র। যারা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তা দিপঙ্কর তঞ্চ্যাঙ্গার ঈশারায় চলে।
সম্প্রতি এমন একটি অভিযোগ পর্যবেক্ষণ করে দেখা মিলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকায় রেলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারির অবৈধ ঘরের সামনে অবৈধ আরেকটি ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন আরেকজন কর্মচারি। এ নিয়ে বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তা দিপঙ্কর তঞ্চ্যাঙ্গার শরাণাপন্ন হন ওই কর্মচারি। যা দেখার জন্য তিনি দায়িত্ব ন্যস্ত করেন বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি দপ্তরের সার্ভেয়ার আবদুস সালামের কাছে।
আবদুস সালাম দখল উচ্ছেদের কথা বলে ওই কর্মচারির কাছ থেকে আদায় করেন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু দখল উচ্ছেদে গিয়ে নতুন দখলদারের কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। এমন অভিযোগ ওই ভুক্তভোগী কর্মচারির। যার একটি ভিডিও তিনি আমাদের কাছে দিয়েছেন। ভিডিওটি এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম কুমিরা স্টেশনে পার্কিংয়ের জায়গাটি কৃষি ভুমি হিসেবে ইজারা হলেও বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক কন্টেইনার টার্মিনাল। সেখান থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে নিরব ভুমিকা পালন করে আসছিলেন আমিন আবদুস সালাম ও বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তা দিপঙ্কর তঞ্চ্যাঙ্গা। বিষয়টি একটি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর উচ্ছেদ করতে গেলে হামলার শিকার হন আরএনবির সদস্যরা। আর হামলার নেপথ্যে নায়ক ছিলেন আমিন আবদুস সালাম ও বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তা দিপঙ্কর তঞ্চ্যাঙ্গা। এমন অভিযোগ আরএনবির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি দপ্তরের আমিন আবদুস সালাম মুঠোফোনে বলেন, এ সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ বিষয়ে কোন কিছু জানতে চাইলে আপনি আমার কন্ট্রোলার বসের সাথে কথা বলুন। আমি কিছুই বলতে পারব না।
তবে এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তা দিপঙ্কর তঞ্চ্যাঙ্গা বলেন, আমি ফোনে কোন কথা বলি না। আপনার কিছু জানতে হলে অফিসে আসুন। পরে অফিসে গেলে তিনি বলেন, আপনি সাংবাদিক কি না আমি তো জানি না। আপনার সাথে আমার আগে থেকে পরিচয় নেই। সেজন্য আমি ফোনে কথা বলিনি।
এ সময় টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে কি বলল, না বলল তা কি সত্যি হয়ে যায়। রেলের এই পদে আসার আগে আমি এক উপজেলায় ইউএনও ছিলাম। আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেট-এসব বিষয় বলে তিনি নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন।
আমিন হিসেবে আবদুস সালাম নামে কেউ আপনার অফিসে আছে কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আছেই তো। তো কি হয়েছে। ওনার বিষয়ে তো আমি কিছুই বলতে পারব না। পরে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রেলের বিপুল পরিমাণ জায়গা অবৈধ দখলে রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোর উচ্ছেদও চলছে।
অবৈধ দখলে আপনার কোন দায় নেই-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দায় আছে, নেই বলছি না। তবে এসব দখল তো আমি বসায়নি। বসালে আগে চেয়ারে যারা ছিলেন তারা বসাইছে। আর উচ্ছেদ করা কি খুব সহজ কাজ। সাম্প্রতিক সময়ে কুমিরায় উচ্ছেদ করতে গিয়ে আরএনবিসহ ভুমি দপ্তরের লোকজন হামলার শিকার হয়েছে।
পাঁচ দিনের মধ্যে রেলওয়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিষয়ে অন্তবর্তী সরকারের রেলপথ উপদেষ্টার নির্দেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধু নির্দেশ দিলে তো হবে না। এ সংক্রান্ত লিখিত কোন নির্দেশনা তো আমরা পায়নি। লিখিত নির্দেশনা আসলেই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আর এ বিষয়ে কথা বলার সময় বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি কর্মকর্তার দপ্তরের সামনে ১৫-২০ জনের মতো অবৈধ ভুমি দখলদার চক্র জড়ো হয়। যারা এই প্রতিবেককে এ্যাটাকের পরিকল্পনা করে। আর এই পরিকল্পনার নেপথ্যে কাজ করেন ঘুষ খাওয়ার দায়ে রেলওয়ের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নিকটবর্তি বিভাগীয় ভু-সম্পত্তি দপ্তরে শাস্তিমুলক বদলি হওয়া কর্মচারি গোলাম কিবরিয়া।
এ বিষয়ে জানতে গোলাম কিবরিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য, বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার দপ্তরে স্টোনো পদে থেকে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিকদের পোস্টিংয়ের নামে জনপ্রতি ২ থেকে ৫ হাজার আদায় করেন গোলাম কিবরিয়া। এছাড়া শ্রমিকদের বাৎসরিক ইউনিফর্ম বিতরণের দুই তৃতীয়াংশ টাকাও হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে। এমনকি ট্রেন চালকদের মাইলেজ বাড়িয়ে বা ভুয়া মাইলেজ দেখিয়ে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
নগরীর টাইগার পাস আমবাগান এলাকায় তার অবৈধ ৮টি ঘর ভাড়া দেওয়া রয়েছে। যেখানে প্রতিমাসে ৬০ হাজার টাকা ভাড়া পান গোলাম কিবরিয়া।
আর পাহাড়তলী এলাকায় দখল ও উচ্ছেদ বাণিজ্যেও নেপথ্যে নায়ক এই গোলাম কিবরিয়া বলে জানান ভুক্তভোগী কর্মচারি। তিনি বলেন, গোলাম কিবরিয়া রেলওয়ে শ্রমিক লীগের রাজনীতি করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সে প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রদের হত্যায় ফ্যাসিস্টদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভুমি বিভাগের তথ্যমতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ২৪ হাজার ৪৪১ একর জমির মধ্যে সম্পূর্ণ বেদখলে রয়েছে ৬১৯.৬৭ একর জমি। অপারেশনাল কাজে ব্যবহার হচ্ছে ১০৩৩১.৩১ একর জমি। অপারেশনাল কাজে ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৯৪০০.৯৬২ একর জমি। রেল বহি:র্ভুত কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬০৪.৮০ একর জমি। গত ২২-২৩ অর্থবছরেও লিজ দেওয়া হয়েছে ২৯.৯১ একর জমি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রেলওয়ে জমির হালনাগাদ তথ্য এটি।