বৃহস্পতিবার, ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ভুয়া ভাউচার বানিয়ে অর্থ আত্মসাতের কারিগর রেলওয়ের হারুন মাস্টার!

প্রথম শ্রেণীর অফিসার না হয়েও দখল করে রেখেছেন বড় বাংলো যেখান থেকে প্রতি মাসে তিনি ভাড়া পান ৮০ হাজার টাকা 

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, বিশেষ প্রতিনিধি।

ভুয়া ভাউচারে অর্থ আত্মসাৎসহ নানান অভিযোগ উঠেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ফেনীর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ হারুনের বিরুদ্ধে। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন মো: সাইফুল ও সেন্টু নামের আরো দুইজন সহকারি রেল স্টেশন মাস্টার।এসব অনিয়মের কারণে  আড়াই মাস পূর্বে সেন্টু কে ফাজিলপুর স্টেশনে বদলি করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে স্টেশন মাস্টার মোঃ হারুন তিন বছরের ও অধিক সময় ধরে ফেনীর রেলওয়ে স্টেশনে মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। রেলওয়ে স্টেশনে অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে ভাড়া আদায় করা ছাড়াও রেলওয়ে রানিং স্টাফদের বিশ্রাম কক্ষও ভাড়া দিয়েছেন বহিরাগতদের কাছে। ফেনী রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। রেলওয়ে তথ্যসূত্রে জানা যায় ফেনীর রেলওয়ে স্টেশনে লাইসেন্সকৃত বরাদ্দকৃত দোকান সংখ্যা ২৩টি । কিন্তু অবৈধভাবে গড়ে উঠা ২ শতাধিকেরও অধিক  দোকান স্টেশন মাস্টার হারুনের নেতৃত্বে  চলছে। প্রতিটি দোকান থেকে মাসে তিনি ২ হাজার টাকা করে ভাড়া আদায় করেন। এছাড়া ২৪ টি মুচির দোকান থেকে দৈনিক হিসাব ২০০ টাকা এবং স্টেশন এবং ট্রেনের ভিতরে ভ্রাম্যমান হকার থেকেও ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন। জানাযায় স্টেশন মাস্টারের আস্থাভাজন বাবুল সরদার নামের এক লোকের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন তিনি।

এছাড়া করেন রেলের টিকেট বাণিজ্যও। নির্ধারিত মুল্যের চেয়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকার বেশি ছাড়া  টিকেট বিক্রি করেন না তিনি। জড়িত তেল চুরির সাথেও। সিলগালা করার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে ৫০ লিটার কেরোসিনের টাকা হাতিয়ে নেন স্টেশন মাস্টার হারুন। স্থানীয় মেসার্স ইদ্রিস এন্ড সন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে সেই টাকা তুলে নেন তিনি। গত বছরের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যবহার করে ভুয়া ভাউচার তৈরীর মাধ্যমে ৫ হাজার ২৫০ টাকা তুলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।এভাবে প্রতি মাসে কোটি টাকা বাণিজ্য করেন তিনি। তবে এর পুরোটা জুটে না তার কপালে। ভাগবাটোয়ারা শেষে তিনি মাসে ভাগে পান ৫/৬ লাখ টাকার মতো।

আরও পড়ুন  চট্টগ্রামে সময়ের আলোর চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

অবৈধ এই আয়ের বাকি টাকার ভাগ চলে যায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ট্রাফিক কর্মকর্তা (ডিটিও), চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস), বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও), চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম), আরএনবি পরিদর্শক, আরএনবি চিফ কমান্ডেট, বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপক (ডিআরএম) ও পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পর্যন্ত।

স্টাফদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ মাসিক ভাড়া দেওয়াই বিশ্রাম নিতে পারছেন না, স্টাপ, ট্রেন পরিচালক, রানিং স্টাফরা। এই নিয়ে স্টাফদের মধ্যে চরম ক্ষোভ অসন্তোষ বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্রেন পরিচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্টেশন মাস্টার হারুন নিজের বাপ দাদার সম্পত্তি মনে করে এসব বাণিজ্য করে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক ভাবে নিরব। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে উল্টো ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বড় স্যারদের সহায়তায় শাস্তি স্বরুপ অন্য জায়গায় বদলি করে দেন। ইতিপূর্বে প্রতিবাদ করায় অনেকের এই দশা হয়েছে তাই মুখ খুলতে নারাজ ভুক্তভোগী কর্মচারীরা।
বরাদ্দকৃত চারটি রুম থেকে প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এই নিয়ে স্টাফদের মাঝে চরম অসন্তোষ থাকলেও রহস্যজনক কারণে এই বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে বুকিং সহকারী মোঃ সাকের মাহমুদের কাছ থেকে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করেন স্টেশন মাস্টার হারুন।
সূত্রে আরও জানা যায়, সিলগালা করার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে ৫০ লিটার কেরোসিনের টাকা হাতিয়ে নেন স্টেশন মাস্টার হারুন। স্থানীয় মেসার্স ইদ্রিস এন্ড সন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে সেই টাকা তুলে নেন তিনি। গত বছরের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যবহার করে ভুয়া ভাউচার তৈরীর মাধ্যমে ৫ হাজার ২৫০ টাকা তুলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে মেসার্স ইদ্রিস অ্যান্ড সন্স নামক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলেন ফেনী স্টেশন মাস্টার আমার দোকান থেকে তেল ক্রয় করেননি। তিনি আমার দোকানের নাম ব্যবহার করে ভুয়া একটি ভাউচার তৈরি করেছেন। এই নিয়ে অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়েছে আমি সবাইকে বলেছি এই কথা।
প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা কিংবা অফিসার না হয়েও দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পাহাড়তলী এলাকায় বিশাল বাংলো বরাদ্দ নিয়ে রাখছেন হারুন মাস্টার। সেখানেও গড়ে তুলেছেন ভাড়া বাণিজ্য। যেখান থেকে তার মাসিক আয় ৮০ হাজার টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ২০০৪ সাল থেকে কথিত আত্মীয় পরিচয়ে ২০ হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে থাকেন রেলওয়ে থেকে অবসরে যাওয়া আরিফুর রহমান। তিনি প্রতিবেদককে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন এই বাংলো হারুন মাস্টারের নামে বরাদ্দকৃত। আত্মীয় হিসেবে আমি থাকি। ভবিষ্যতে স্টেশন মাস্টার থেকে প্রমোশন পেয়ে হারুন মাস্টার অফিসার হবেন তাই পূর্ব থেকে এই বাংলো দখল করে রেখেছেন।
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরিফুর রহমানের ছেলে আসিফ বলেন, আমরা হারুন মাস্টার থেকে ২০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে থাকি। এরকম আরো ছয়টি পরিবার রয়েছে তারাও ১২-১৫ হাজার টাকা ভাড়া দেন হারুন মাস্টারকে। অবশ্যই একটি রুম হারুন মাস্টারের জন্য বরাদ্দ রয়েছে তিনি চট্টগ্রামে আসলে এখানে থাকেন ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী স্টেশন মাস্টার মুহাম্মদ হারুন প্রতিবেদককে বলেন, আমার স্টেশনে ২৩টি বৈধ দোকান আছে অবৈধ কোন দোকান নেই। বাইরে আর কোথায় দোকান আছে সে বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। থাকলে আমার দেখার বিষয় না সেটা স্টেট ডিপার্টমেন্ট দেখবে। প্রতি দোকান থেকে ২০০ টাকা ভ্রাম্যমান হকার থেকে ১০০ টাকা চাঁদা নেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন ভ্রাম্যমান হকার থেকে টাকা নেওয়ার সুযোগ নাই।
কেরোসিন তেলের ভুয়া ভাউচার দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিলগালা করার জন্য যেসব কেরোসিন তেল প্রয়োজন হয় তা আমি বরাদ্দ দিই ঠিকেই, তবে এসব আমি ব্যবহার করিনা ওইগুলো গেটম্যান পয়েন্টস মেন্ট ওরাই এগুলো ব্যবহার করে থাকেন। কোন কিছু অনিয়ম করে থাকলে তারাই করেছে এগুলোর সাথে আমি সম্পৃক্ত নয়।
অফিসার না হয়ে বাংলো বরাদ্দ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন এটা কোন বাংলো না এটা বাংলোর অর্ধাংশ। এটা ডিভাইডেড করে দুইজনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদকে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আপনি তো দেখে আসছেন আপনি বলেনতো কত টাকা ভাড়া পায়? আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে সবগুলো ভুয়া এগুলোর কোনটিই সঠিক নয়।

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ডিটিও আনিসুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। বুধবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে অফিসে গেলেও দেখা যায় দরজার বাইরে সিটকারি লাগানো। এ সময় অফিসের পিয়ন স্বপন বলেন, স্যার অফিসে খুব কম থাকেন। দিনের বেশিরভাগ তিনি স্টেশনে স্টেশনে ঘুরেন।

আরও পড়ুন  প্রাবন্ধিক নুরুল মুহাম্মদ কাদেরের মোবাইল ফোন ছিনতাই 

একাধিকবার ফোন করার পরও ফোন ধরেননি চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) শহিদুল ইসলামও। বুধবার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। একই অবস্থা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মাহবুবুল আলমেরও। একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বুধবার বিকেলে অফিসে গিয়ে দেখা যায়, তিনি দরজা বন্ধ করে কতিপয় ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারের সাথে গোপন আলাপ করছেন।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভুমি বিভাগের তথ্যমতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ২৪ হাজার ৪৪১ একর জমির মধ্যে সম্পূর্ণ বেদখলে রয়েছে ৬১৯.৬৭ একর জমি। অপারেশনাল কাজে ব্যবহার হচ্ছে ১০৩৩১.৩১ একর জমি। অপারেশনাল কাজে ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৯৪০০.৯৬২ একর জমি। রেল বহি:র্ভুত কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬০৪.৮০ একর জমি। গত ২২-২৩ অর্থবছরেও লিজ দেওয়া হয়েছে ২৯.৯১ একর জমি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রেলওয়ে জমির হালনাগাদ তথ্য এটি।

(সম্মানীত পাঠকবৃন্দ : রেলওয়ের দূর্নীতিবাজ কর্মচারী মোহাম্মদ হারুনের  সম্পদের তথ্য নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সবাই চোখ রাখুন citynewstv24.com)
শেয়ার করুন