বৃহস্পতিবার, ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বছরে ৫শ কোটি টাকার তেল চুরি

কক্সবাজারে অবৈধভাবে তেল সংগ্রহকালে বিদেশি জাহাজ আটক

জড়িত একাধিক চক্র, আছে গোপন ডিপো

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, বিশেষ প্রতিবেদক।।

কক্সবাজারে কুতুবদিয়া উপকূলের অদূর সাগরে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে জ্বালানি তেল অবৈধভাবে সংগ্রহের সময় পানামার পতাকাবাহী বিদেশি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ আটক করেছে কোস্টগার্ড।

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলবর্তী অদূর সাগরের বহির্নোঙর এলাকায় এ অভিযান চালানো হয় বলে জানান কোস্টগার্ড সদর দফতরের গণমাধ্যম কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. সিয়াম-উল-হক।
ক্রুসহ আটক জাহাজটি চট্টগ্রাম বহির্নোঙর সাগরে কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে বলে জানান সিয়াম-উল-হক। তিনি বলেন, শনিবার সকাল থেকে কুতুবদিয়া বহির্নোঙ্গর সাগর এলাকায় কোস্টগার্ডের জাহাজ ‘অপূর্ব বাংলা’ নিয়মিত টহল দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে বাংলাদেশি সন্দেহজনক ওয়েল ট্যাংকার ‘ওটি ইউনিয়ন’ এবং পানামার পতাকাবাহী বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ ‘এমটি ডলফিন-১৯’ জ্বালানি তেল আদান-প্রদান করতে দেখে কোস্টগার্ড সদস্যরা। পরে কোস্টগার্ড সদস্যরা বাংলাদেশি ও বিদেশি জাহাজ দুইটির সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে উভয় জাহাজ কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা কুতুবদিয়া বহির্নোঙ্গর সাগরে নোঙ্গর করা এবং জ্বালানি তেল সংগ্রহ কিংবা প্রদানের স্বপক্ষে বৈধ কোনো ধরণের কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. সিয়াম-উল-হক আরও বলেন, পানামার পতাকাবাহী বিদেশি জাহাজটি মোংলা সমুদ্রবন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শনিবার সকাল ৭টায় জাহাজটি সেখানে না গিয়ে কুতুবদিয়া বহির্নোঙর সাগরে নোঙর করে। এছাড়া চট্টগ্রামবন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত বিদেশি জাহাজটি অবৈধভাবে বাংলাদেশি ওয়েল ট্যাংকার থেকে দুপুর ২টায় জ্বালানি তেল সংগ্রহ করছিল। প্রায় ৭ ঘণ্টা পর দুপুর ২টা পর্যন্ত ৩৫৬ মেট্টিক জ্বালানি সংগ্রহ করেছে।

সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিদেশি জাহাজটিতে তেল সরবরাহ করা হচ্ছিল তথ্য দিয়ে সিয়াম-উল-হক বলেন, বাংলাদেশি ৯ জন ক্রুসহ জাহাজ দুটি চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্নোঙরে কোস্টগার্ডের তত্ত্বাধানে রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মেরিন কোর্টের মাধ্যমে জাহাজ দুটিকে জরিমানা আদায়সহ ঘটনার ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য দীর্ঘদিন ধরে তেল চুরির সিন্ডিকেটরা সক্রিয় রয়েছে। যারা দেশে এবং বিদেশে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তেল বিক্রি করছেন। জড়িত একাধিক চক্র, আছে গোপন ডিপো। বছরে ৫শ কোটি টাকার তেল চুরি হয় বিভিন্ন উপায়ে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসা দেশি–বিদেশি চার হাজারের বেশি জাহাজ এবং দেশের জ্বালানি তেলের প্রধান ডিপোকে কেন্দ্র করে বছরে অন্তত ৫শ কোটি টাকার তেল চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র নানা কৌশলে তেল পাচারের সাথে জড়িত। কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে বিলিবণ্টন করে তেল চোরাচালানের রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। প্রভাবশালীদের কেউ কেউ তেল চোরদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেয়ায় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানিকৃত তেলের চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং পতেঙ্গা, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী থানা এলাকায় অপতৎপরতা বেড়েছে।
দেশের জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানি এবং বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে। নিজেদের তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা অয়েল, যমুনা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে দেশব্যাপী জ্বালানি তেল বাজারজাত করা হয়। প্রচলিত আইনে ব্যক্তি পর্যায়ে জ্বালানি তেল আমদানি বা বাজারজাতের সুযোগ নেই। অথচ আইন ভেঙে সংঘবদ্ধ চক্র জ্বালানি তেল কেনাবেচা থেকে শুরু করে লোপাট ও পাচার করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে দেশি–বিদেশি প্রচুর জাহাজ আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসার সময় এসব জাহাজ নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তেল নিয়ে আসে। এসব তেল চট্টগ্রামে এনে স্থানীয় চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের নিকট বিক্রি করে। কোনো শুল্ক পরিশোধ করা হয় না। তাই তুলনামূলক সস্তায় তেলগুলো কিনতে পারে চোরাকারবারিরা। পরে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প কিংবা স্থানীয় লাইটারেজ জাহাজগুলোতে বিক্রি করা হয়। সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকায় সংঘবদ্ধ চক্র বাজারদরের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, পতেঙ্গার গুপ্তাখালে জ্বালানির তেলের প্রধান ডিপো হওয়ায় চক্রটি সুবিধা পাচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে তেল পরিবহন করা হয়। জলে এবং স্থলপথে পরিবাহিত এসব তেলের একটি অংশ চক্রটি কৌশলে লোপাট করে। চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানোর সময় জাহাজ থেকে পথে তেল সরিয়ে নেয়ার ঘটনা ‘ওপেন সিক্রেট’। তেল সরিয়ে নদীর পানি দেয়ার কাহিনি এখন পুরনো। পুরো জাহাজের তেল লোপাট করে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রামের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি ও বিরোধী দলীয় নেতা, প্রশাসনের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাসহ শ’খানেক মানুষ তেল চুরি, পাচার এবং লোপাটের সাথে জড়িত। পৃথক সিন্ডিকেটে থাকা চক্রটি চট্টগ্রামে বছরে অন্তত ৫শ কোটি টাকার তেলের চোরাচালান করে বলে সূত্র জানিয়েছে।

আরও পড়ুন  বাঁশখালীতে সাংবাদিকসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা 

সূত্র জানায়, নগরীর পতেঙ্গা, ইপিজেড, কর্ণফুলী, বাকলিয়া, কোতোয়ালী, সদরঘাট ও বন্দর এলাকা ঘিরে তেল চোরাচালানি সিন্ডিকেটের তৎপরতা চলে। কর্ণফুলী নদীর ১১ নং মাতব্বর ঘাট, ১২ নং তিন টেইগ্যার ঘাট, ১৩ নং ঘাট, ১৪ নং কালু মাঝির ঘাট, ১৫ নং মেরিন একাডেমি ঘাট, জুলধা ইউনিয়নের ঘাট, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের বাংলাবাজার ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, চরপাথরঘাটা পুরনো ব্রিজঘাট, চাক্তাই ঘাট, সদরঘাট ও ফিশারিঘাটসহ বিভিন্ন পয়েন্টে তেল চোরাচালানিদের কার্যক্রম চলে।
স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, কর্ণফুলী এলাকায় চোরাই ফার্নেস অয়েল মজুদ করার বেশ কয়েকটি গোপন ডিপো রয়েছে। ওখানে মাটির নিচে ট্যাংক রয়েছে। জাহাজ থেকে চোরাই পথে কিনে আনা তেল এসব ডিপোতে লুকিয়ে রাখা হয়। পরে সুবিধাজনক সময়ে ডেলিভারি দেয়া হয়। গুপ্তাখালের ডিপো এবং পরিবহনকালে জাহাজ থেকে নেয়া পরিশোধিত পেট্রোল, ডিজেল ও অকটেন সরাসরি নৌকায় করে মাঝিরঘাট, ব্রিজঘাট ও চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। পরবর্তীতে এসব তেল স্থানীয় বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প এবং জাহাজে বাংকারিং করা হয়।

শেয়ার করুন