* চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা সেবা।
* চমেকে অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা, ভোগান্তি ক্যান্সার রোগীদের।
*ক্যান্সার রোগের যে দশটি উপসর্গ অবহেলা করা যাবেনা।
*বিএসএমএমইউর গবেষণা দেশে ক্যান্সার রোগী প্রতি লাখে ১০৬ জন
‘আমি ক্যানসার রোগী—এভাবে কখনো ভাবতে চাইতাম না। কিন্তু কেমোথেরাপির পর যখন চুলগুলো পড়ে গেল, তখন আর সহ্য করতে পারিনি। কঠিন বাস্তবতা বুঝতে পারি। তবে বন্ধু-স্বজনরা পাশে ছিলেন, আছেন এবং চিকিৎসক যখন বলেন, তুমি ভালো হয়ে যাবে, তখন লড়াই করার সাহস পাই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা সাবেক এডিশনাল ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আবুল বশর (৬৫) কথাগুলো বলতে বলতে নিজের আবেগ আর ধরে রাখতে পারলেন না। তার কান্নায় চোখও ভিজে উঠল। অবসর নিয়েছেন ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এর মধ্যেই ক্যান্সার আক্রান্ত হন তিনি। চাকরির সাথে দীর্ঘ ১২ বছর যুদ্ধের পর তিনি এখন ক্যান্সার মুক্ত। ক্যান্সার জয় কেমন লাগছে জানতে চাইলে ফুটফুটে গোলাপের মতো মুখে হাসি ছড়িয়ে দেন তিনি গত ২৮ জানুয়ারি সাক্ষাতের শুরুতে তিনি বলেন আমাকে কি রোগীর মত লাগছে? আবুল বশরের চেহারা দেখলে বুঝা বড় মুশকিল তিনি অসুস্থ। কিন্তু হাঁটছেন স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে। তারপরও তৃপ্তি হাসি দিয়ে তিনি বলেন গত কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের ক্যান্সার ইনিস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার শেফাতুজ্জাহান পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন আমাকে বলেন আমার শরীরে ক্যান্সারের কোন জার্ম নাই। শুনে আমার খুব ভালো লাগছিল। মুহূর্তে মনে হয়েছে আমি ২৫ বছরের একজন টগবগে যুবকে পরিণত হয়েছি। কারণ তার চিকিৎসায় আমি নতুন জীবন পেয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি। আবুল বাশার বলেন,আমি কোন বিয়ে করিনি।জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মত আমার আর কিছু নাই। তারপরেও পৃথিবীর সুন্দর আলো বাতাস দেখে বাঁচতে চাই। আমি আপনার মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের বলতে চাই আপনারা সুচিকিৎসা চাইলে ডাক্তার শেফাতুজ্জাহানের কাছে আসুন। উনি একজন মানবিক ডাক্তার। প্রয়োজনে সাপেক্ষে ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে প্রচুর স্টাডি করেন এরপরে দেন চিকিৎসা। ক্যান্সার জয়ের আগে আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে আবুল বশর বলেন, ২০১১ সালের শেষের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মরত থাকা অবস্থায় আমার মেরুদন্ডে ব্যথা অনুভব হয়। তখন চট্টগ্রামের একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তিনি বলেন, আমার টিউমার হয়েছে। পরামর্শ দেন অপারেশনের। পরে পপুলার হাসপাতাল এপোলো হাসপাতাল সহ বাংলাদেশের একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় অপারেশনে অপরাগ ছিলাম। এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের একজন হোমিও বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা নিই।বছর দেড়েক ব্যথা মুক্ত জীবন কাটায়। পরে ব্যাথা শুরু হলে হোমিও বিশেষজ্ঞ পরামর্শে ফের পপুলার হাসপাতালের শরণাপন্ন হই। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বলা হয় টিউমার ক্যান্সার। তখন যমদূতকে খুব কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল বেশিদিন আর বাঁচবো না মৃত্যু অতি সন্নিকটে। সিদ্ধান্ত নিয়ে অপারেশনের তারপরেও ব্যথা কমেনি। পরে পিজি হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষায় বলা হয় অপারেশন হয়েছে আংশিক টিউমার পুরোটাই রয়ে গেছে ভেতরে। স্ক্র্যাচে মেয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে ফের ব্যথা অনুভব শুরু হলে আমি একপ্রকার কাহিল হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত পিজি হাসপাতাল আমাকে রেফার করে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও রিচার্জ সেন্টারের পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার শেফাতুজ্জজাহানের কাছে। তার জাদুঘরি হাতের ছোঁয়ায় দক্ষ চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে আমি বর্তমানে এখন ক্যান্সার মুক্ত।
ক্যানসার রোগী ও তার পরিবারকে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক—এই ৩ ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।’
পিজি হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শে ফের অপারেশনে গেলাম এরপর কয়েক বছর ভালো ছিলাম পর্যায়ক্রমে আমি পঙ্গু হয়ে যাচ্ছি।
বর্তমানে মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার শেফাতুজ্জাহানের নিবিড় পরিচর্যায় বেশ ভাল আছি। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জীবনের গল্পগুলো প্রায় একই রকম।
চট্টগ্রামে সরকারিভাবে ক্যানসার রোগীর সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে শুধু চমেক হাসপাতালে। হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ক্যানসার রোগী আসছেন ১৫০-২০০ জন। এ বিভাগে ইনডোর সিট রয়েছে ২৪টি।
এছাড়া গত বছর নতুন ও পুরাতন মিলে চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯ হাজার ৯৬৫ জন ক্যানসার রোগী। এরমধ্যে নতুন রোগী ছিল ছয় হাজার ৪৪৭ জন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যানসার ইনস্টিটিউটে রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫ হাজার ৬৩৩ জন ক্যানসার রোগী। এর মধ্যে নতুন রোগী ছিল চার হাজার ৭৭২ জন।
সংখ্যায় কম হলেও চিকিৎসা সুবিধার কারণে এ হাসপাতালে ক্যানসার রোগী ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে এই হাসপাতালে পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডে ৬০ শয্যায় ক্যানসার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অথচ এই হাসপাতালে ১২০ শয্যায় ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার সক্ষমতা রয়েছে। হাসপাতালের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোরশদে হোসেন ও জেনারেল সেক্রেটারি মো: রেজাউল করিম আজাদের দক্ষ নেতৃতৃে গত বছরের ৫ নভেম্বর জনগনের অর্থায়নে প্রায় ১৩০ কোটি ব্যায়ে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার নির্মিত হয়।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর স্বজনের ভাষ্য, সরকারি হলেও চমেক হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়। ঠিকমতো ডাক্তার থাকেন না। এখানে দুপুরবেলায় মোটেও ডাক্তারের দেখা পাবেন না। ডাক্তাররা সকালে কোন মতে এসে নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে চলে যান নিজ চেম্বারে রোগী দেখতে।
এমন সংবাদের ভিত্তিতে সরেজমিনে তিন তিন বার দুপুরবেলায় প্রতিবেদক চমেক হাসপাতালে গেলে এমন দৃশ্য ধরা পড়ে। ওই ডিপার্টমেন্টের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ কোন ডাক্তারের দেখা মিলেনি। চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডাক্তার সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফের অফিস তালাবদ্ধ। অথচ মেডিকেলের বারান্দায় শত শত ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা জীবনের শেষ নিশ্বাস নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি না থাকায় ঢাকা ও দেশের বাইরে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে । এতে ব্যয় ও দুর্ভোগ বাড়ছে। অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা, ভোগান্তি ক্যান্সার রোগীদের। রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র কদিন পরপরই নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে সেখানে সেবা পাচ্ছে না ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা।
পক্ষান্তরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর স্বজন বলেন, এই হাসপাতালে এখন খুব দ্রুত রোগ নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে। সিটি সিমুলেটর, লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনসহ অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি রয়েছে এই হাসপাতালে। যদিও এই সুবিধার কথা এখনো অজানা অনেকেরই।
হাসপাতালের অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শেফাতুজ্জাহান বলেন, মাত্র তিন বছর আগে এই হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়। যা এখন ক্যানসার ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রামের মানুষের সহযোগিতায় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক চেষ্টায় এই হাসপাতালে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এই মেশিনের কারণে হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা অনেকটা এগিয়ে গেছে। আর এটা শুধু হাসপাতাল নয়, মেডিকেল কলেজও। এখানে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিমও। সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে রয়েছেন দেশের প্রখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাক্তার কামরুজ্জামান চৌধুরী।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যার সম্মুখভাগে ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে চিকিৎসা সেবায় যুদ্ধ করে যাচ্ছেন ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মানবিক ডাক্তার সহযোগী অধ্যাপক শেফাতুজ্জ জাহান।যার নিরলস প্রচেষ্টায় হাজার হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা সেবা পাচ্ছেন আশার আলো দেখছেন দীর্ঘ জীবনের।
ডাক্তার শেফাতুজ্জাহান বলেন, ক্যান্সারের নাম শুনলেই বেশিরভাগ মানুষ যেটি মনে করেন তা হচ্ছে, এটি একটি মারাত্মক রোগ যাতে আক্রান্তরা মারা যান।কিন্তু ৭০ এর দশকের পর থেকে ক্যান্সারে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার তিনগুণ বেড়েছে। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করানোর কারণে। বাস্তবে, বেশিরভাগ ক্যান্সারই চিকিৎসা যোগ্য এবং যেসব রোগীরা খুব মারাত্মক পর্যায়ের অর্থাৎ ফোর্থ স্টেজে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পেলেই তারা একটি ভাল ফলও পান।সমস্যা হচ্ছে, অনেক সময় আমরা ছোট-খাট উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে চাইনা বা সেগুলোকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেই না। এসব উপসর্গকে আমরা এড়িয়ে চলি যা আসলে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
তিনি আরোও বলেন, ক্যানসার রোগ জটিল, তবে দুরারোগ্য নয়। প্রাথমিক অবস্থায় সুচিকিৎসা পেলে এই রোগ জয় করা সম্ভব। এছাড়া এই রোগ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ভেজাল খাবার গ্রহণে সচেতন হওয়া। এ বিষয়ে সরকারেরও পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ভেজাল খাবারের কারণে বাংলাদেশ এখন ক্যানসার রোগীর কারখানা হয়ে গেছে। এই সুযোগে প্রতিবেশী দেশ ভারত ক্যানসার চিকিৎসার কারখানা বানিয়ে ফেলেছে। আমরা এই দুই কারখানা রিমুভ করতে চাই। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ ভেজাল খাবার গ্রহণে সচেতনতার ওপর কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। আবার ভারতের চিকিৎসা কারখানা ভাঙতে গরিব ক্যান্সার আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিনামুল্যে ওষুধ প্রদান করছে। এ কারণে ক্যানসার রোগীদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ।
বিশেষায়িত এই হাসপাতালে রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সারের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে দুই কোটি মানুষের মধ্যে ৫ লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। বছরে গড়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ১৩৬ জন নতুনভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতিতে আছে। এ তুলনায় ক্যান্সারের পর্যাপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা চট্টগ্রামে নেই বললেই চলে।
চমেক হাসপাতালে ভর্তি ক্যান্সার আক্রান্ত আব্দুল মান্নান (৬০) বলেন,আমাদের মতো গরিব মানুষের অনেকটা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এখানেও চিকিৎসা সেবার খরচ বেশি। টাকার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি।আমার মত অনেকেই বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সার আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন বলেন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২১ সালে ১৫০ শয্যার ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। হাসপাতালের পাশে সরকার থেকে পাওয়া ১০ কাঠা জমিতে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণকাজ শুরু হয়। দেশ-বিদেশে মানুষের আর্থিক অনুদানে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের মানুষের কথা চিন্তা-ভাবনা করে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও রিসার্চ সেন্টার চালু করা হয়।
সবার সহযোগিতা পেলেই ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এই সেবা বৃদ্ধি করতে পারব।
১৯৭৯ সালে কয়েকজন চিকিৎসক,রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তার হাত ধরে শুরু হওয়া উদ্যোগটি এখন ১০৫০ শয্যার চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। বর্তমানে হাসপাতালের বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ এবং অন্তঃবিভাগে ৮৫০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। এখানে ৪০০ চিকিৎসকসহ প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। মূলত প্রায় ১০ হাজার অধিক আজীবন সদস্য ও ৪০০ দাতা সদস্য, সরকারি-বেসরকারি অনুদানে চলে বৃহৎ এই হাসপাতালটি।
ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আজাদ বলেন। চট্টগ্রামে বেসরকারি উদ্যোগে সর্বপ্রথম ক্যান্সার চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হলো। এখানে ক্যান্সারের বিশ্বমানের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। টাকার অভাবে কোন রোগী যেন হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে আমাদের নজর রয়েছে। চট্টগ্রামে ৮০ লক্ষ মানুষ হয়েছে প্রত্যেকে এক টাকা করে অনুদান দিলেও ৮০ লক্ষ টাকা হয়।বর্তমানে ইন্ডিয়ার ভিসা বন্ধ থাকায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের একটি মেশিন রয়েছে আরোও একটি মেশিন দরকার। সবার সহযোগিতা পেলেই চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল বিশ্বমানের একটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হবে।
যুক্তরাজ্যের ক্যান্সার গবেষণা সংস্থার এক গবেষণা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা জীবনের কোন না কোন সময়ে এমন কোন উপসর্গে ভুগেছেন যেটি আসলে ক্যান্সারের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ মনে করেছেন যে এর কারণে তাদের ভুগতে হতে পারে এবং এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ একে কোন ধরণের পাত্তাই দেননি এবং এর ফলে চিকিৎসকের কাছেও যাননি।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একজন গবেষক এবং এই ক্যান্সার গবেষণার প্রধান ক্যাটরিনা হুইটেকার বলেন: “মানুষ মনে করে যে, মানুষকে স্বাস্থ্য নিয়ে অতি উদ্বিগ্ন হতে উৎসাহিত করা আমাদের উচিত নয়। কিন্তু আমরা এমন মানুষও পেয়েছি যারা চিকিৎসকের কাছে যেতে বিব্রত বোধ করে কারণ তারা মনে করে যে, তারা আপনার সময় নষ্ট করছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্পদ যথেচ্ছভাবে নষ্ট করছেন।

তিনি বলেন, “আমাদেরকে এই বার্তা পাঠাতে হবে যে, আপনার যদি এমন কোন উপসর্গ থাকে যেটা সহসাই যাচ্ছে না, বিশেষ করে এমন সব উপসর্গ যেগুলোকে হুঁশিয়ারি সংকেত হিসেবে মনে করা হয়, তাহলে সেগুলোকে অবহেলা না করে আপনার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত এবং তার সহায়তা চাওয়া উচিত।”
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি যে ১০টি সাধারণ উপসর্গকে অবহেলা করা উচিত নয় মনে করেন ডাক্তার শেফাতুজ্জজাহান তিনিও এই বিষয়ে একমত পোষণ করেন। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার তাগিদ তার।
(১) কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া
ক্যান্সার আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই কোন না কোন সময় ওজন হারাতে শুরু করে। যখন আপনি কোন ধরনের কারণ ছাড়াই ওজন হারাতে শুরু করেন, এটাকে বলা হয় ব্যাখ্যাহীন ওজন হারানো। এতে চিন্তার কারণ আছে।
ব্যাখ্যাহীনভাবে বা কোন কারণ ছাড়াই পাঁচ কেজি বা তার বেশি ওজন কমলে সেটি ক্যান্সারের প্রথম লক্ষণ হতে পারে।অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, খাদ্যনালী বা ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়ার এই লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
(২) জ্বর-
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে সাধারণ একটি উপসর্গ হচ্ছে জ্বর। অবশ্য যে স্থানে ক্যান্সার উৎপন্ন হয়েছে সেখান থেকে দেহের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া শুরু হলে তখন প্রায়ই জ্বর দেখা দেয়।ক্যান্সারে আক্রান্ত সবাই কোন না কোন সময় জ্বরে ভোগেন। বিশেষ করে যদি ক্যান্সার বা এর চিকিৎসা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে তাহলে জ্বর বেশি হয়।অনেক ক্ষেত্রে জ্বর ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গও হতে পারে। যেমন লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা।
৩. ক্লান্তি
এখানে ক্লান্তি বলতে বোঝায় চরম ক্লান্তিভাব যা বিশ্রাম নেয়ার পরও দূর হয় না। ক্যান্সার বাড়ার সাথে সাথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে।কিছু কিছু ক্যান্সার যেমন লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে শুরুর দিকেই ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।কিছু কোলন বা মলাশয় ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রক্তপাত হতে পারে তবে এটা সবক্ষেত্রে হয় না। এর কারণেও ক্যান্সারের সময় ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
৪. ত্বকে পরিবর্তন
ত্বকের ক্যান্সার ছাড়াও আরো কিছু ক্যান্সার রয়েছে যাতে আক্রান্ত হলে ত্বকে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে রয়েছে: ত্বক কালো হয়ে যাওয়া বা হাইপারপিগমেনটেশন ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া বা জন্ত্ লাল হয়ে যাওয়া। চুলকানি
মাত্রাতিরিক্ত চুলের বৃদ্ধি
৫. অন্ত্রের ক্রিয়া বা মূত্রাশয়ের কার্যক্রমে পরিবর্তন কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া বা আপনার মলের আকারে দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তন মলাশয়ের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
অন্যদিকে প্রস্রাব করার সময় ব্যথা, প্রস্রাবে রক্তপাত, বা মূত্রাশয়ের কার্যক্রমে পরিবর্তন যেমন আগের তুলনায় কম বা বেশি প্রস্রাব করা ইত্যাদি মূত্রাশয় বা প্রোস্টেট ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
৬. যে ক্ষত ভাল হয় না-
অনেকেই জানেন যে দেহে যদি কোন আঁচিল থাকে যেটি বাড়ে বা ব্যথা হয় বা সেটি থেকে রক্তপাত হয় তাহলে সেটি ত্বকের ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে। কিন্তু শরীরে যদি কোন ক্ষত থাকে যেটি চার সপ্তাহের পরও ভাল হয় না বা সেরে যায় না, এমন ক্ষতের প্রতিও আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।মুখে যদি এমন কোন ক্ষত হয় তাহলে সেটি মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।আপনার মুখের যেকোন পরিবর্তন যদি দীর্ঘ সময় ধরে থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই একজন চিকিৎসক বা ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেয়া উচিত।শিশ্ন বা জরায়ুতে ক্ষত হয় কোন ধরণের সংক্রমণ কিংবা ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থার লক্ষণ হতে পারে। এমন অবস্থায় একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর পরামর্শ নেয়া উচিত।
৭. রক্তপাত
ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় কিংবা তা ছড়িয়ে পড়ার পর অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে। কাশির সাথে রক্তপাত ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।অন্যদিকে যদি মলের সাথে রক্তপাত হয় তাহলে এটি মলাশয় বা মলদ্বারে ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
এনডোমেট্রিয়াম বা জরায়ুর আবরণে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের কারণে যোনিপথে অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে।এছাড়া মূত্রের সাথে রক্ত পড়লে সেটি মূত্রাশয় বা কিডনি ক্যান্সারের কারণে হতে পারে। স্তনবৃন্ত বা স্তনের বোটা থেকে রক্ত-মিশ্রিত তরল বের হলে সেটি স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।শরীরের যে কোন স্থান শক্ত হয়ে যাওয়া-অনেক ক্যান্সার ত্বকের মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে। এ ধরণের ক্যান্সার সাধারণত স্তন, অণ্ডকোষ, গ্রন্থি এবং শরীরের নরম টিস্যুতে হয়ে থাকে।এক্ষেত্রে দেহে শক্তভাব বা মাংস জমে আছে- এ ধরণের অনুভূতি হয়। এটা এসব ক্যান্সারের প্রাথমিক বা বিলম্বিত উপসর্গ হতে পারে।
১০. টানা কাশি বা কণ্ঠস্বরে পরিবর্তনটানা কাশি ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।এছাড়া কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসলে তা স্বরযন্ত্র বা থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।
ক্যান্সার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবক্যানের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং ৯১ হাজার ৩৩৯ জন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেনবর্তমানে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৩ থেকে ১৫ লাখ। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি এক লাখে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন। এছাড়া প্রতি বছর এ রোগে নতুন করে ৫৩ জন আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশের জন্য দায়ী ক্যান্সার।
বিশেষজ্ঞরা ডাক্তারদের মতে, এভাবে দিন দিন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লে একটা পর্যায়ে ক্যান্সার একটি মহামারী আকার ধারণ করবে।












