চট্টগ্রামে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে।দেরিতে ছেড়ে আসা কক্সবাজারগামী পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে নগরগামী প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের ক্রসিং হয়েছে জান আলী হাট রেলওয়ে স্টেশনে। তবে টাইমিং হওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা জনিত বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। রবিবার (১০ আগস্ট) দুপুর ২টার দিকে এ ক্রসিং হয়েছে।
দুটি ট্রেনের ক্রসিং নিম্নলিখিত কারণে হয়ে থাকে:
(১)একই লাইনে বিপরীতমুখী ট্রেন:যখন দুটি ট্রেন একই রেললাইন ধরে বিপরীত দিকে চলাচল করে, তখন তাদের মধ্যে ক্রসিংয়ের প্রয়োজন হয়।
(২) স্টপেজ বা স্টেশন:ক্রসিং সাধারণত স্টেশন বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে হয়ে থাকে, যেখানে একটি ট্রেন অন্য ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে বা পথ ছেড়ে দেয়।
(৩) সিগন্যাল সিস্টেম:রেলওয়ে সিগন্যাল সিস্টেম নিশ্চিত করে যে, একটি ট্রেন অন্য ট্রেনের জন্য নিরাপদ পথ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত যাত্রা শুরু করবে না।
(৪) ট্রেন চলাচল নিয়ন্ত্রণ:ক্রসিংয়ের মাধ্যমে ট্রেনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।
কিন্তু আজকের ট্রেন ক্রসিং ঘটনাটি কোন প্রক্রিয়া ও কার গাফিলতের কারণে হয়েছে তা জানা যায়নি।
চট্টগ্রামে, বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ রুটে এই ধরনের ক্রসিং দেখা যায়। অনেক সময় অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন এবং গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে, যা খুবই বিপজ্জনক।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০৩ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয় ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। নির্মাণকাজ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয় ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে। প্রথমে এক জোড়া ট্রেন চললেও এখন চলছে চার জোড়া ট্রেন।রেললাইনের লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় এবং রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে অনেকে মারা গেছেন।
কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরুর পর তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ট্রেনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রেলপথ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নতুন নির্মিত এই রেলপথের ৭২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৬টিতে কোনো গেটম্যান এবং প্রতিবন্ধকতা বা ব্যারিয়ার নেই। এর ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে গত ২০ মাসে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ১৭ জনের এবং চলতি বছরের ২ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রেলপথের লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় এবং রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে এসব মৃত্যু হয়। এ ছাড়া গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাতে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় একটি হাতি।
সর্বশেষ গত শনিবার কক্সবাজারের রামুর রশিদনগর এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় এক পরিবারের ৩ জনসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়। যে লেভেল ক্রসিংয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে, সেটি রেলওয়ের অনুমোদিত। তবে অরক্ষিত এই ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান ছিল না।
লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় হতাহতের ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গেটম্যান বা গেটকিপারের অবহেলা জনিত কারণে হয়ে থাকে।কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে ঘটনার পরপরই তাকে সাময়িক বরখাস্ত, গ্রেফতার অথবা তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তই হয় না। মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে সুরক্ষিত করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান,কেবল লেভেল ক্রসিং নয়, ট্রেনে কাটা পড়ে বিভিন্ন স্থানে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এজন্য তারা মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করেন। ২০২২ সালে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছিল।
রেলওয়ে সূত্র জানায়,ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশাপাশি চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ রুটগুলোয় থাকা লেভেল ক্রসিংয়ের অর্ধেকই অবৈধ। মাঠপর্যায়ে রেলের ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এ হিসাবে প্রায় ৪৮ শতাংশ লেভেল ক্রসিং অবৈধ। ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় দেড় শতাধিক ক্রসিং রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মীরসরাই উপজেলার ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। সীতাকুণ্ডের ৩৮ কিলোমিটারের মধ্যে ৬০টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আরও ২০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব ক্রসিং একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলের ৫১১টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ২৫৭টিতে গেট ব্যারিয়ার বা লোহার বার রয়েছে। এর মধ্যে ২২৯টিতে গেটম্যান থাকলেও বাকিগুলোয় থাকে না। অবৈধ ক্রসিংগুলোয় কোনো গেটম্যান নেই। এ কারণে যানবাহন ও মানুষজন নিজ দায়িত্বে রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হয়। অসাবধানতায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
শনিবার নগরীর ঝাউতলা, কদমতলীসহ বেশ কয়েকটি লেভেল ক্রসিংয়ে সরেজমিন দেখা যায়, ট্রেন আসার কয়েক মিনিট আগে সড়কের দুই পাশ আটকে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ট্রেন আসার কয়েক মুহূর্ত আগেও অধিকাংশ যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে উলটো পথে রেললাইনের ওপর দিয়ে পারাপার করতে দেখা যায়। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালনকারী পতাকা উড়ান। এরপরও অনেককে লেভেল ক্রসিং হেঁটে পার হতে দেখা যায়। তবে যানবাহন ও মানুষজনকে পারাপারে বাধা দিতে গেটম্যানদের দেখা যায়নি। ঝাউতলা রেলগেটে দায়িত্বরত গেটম্যান জানান, ট্রেন আসার আগে দুই সড়কের মুখে লোহার বার ফেলা হয়। এ সময় উলটোপথে যানবাহন ও মানুষজন চলাচল শুরু করে। আমরা নিষেধ করলেও কাজ হয় না। উলটো তাদের মারধর করার চেষ্টা করা হয়। নিষেধ করতে গিয়ে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়।
জান আলী হাট রেলওয়ে স্টেশন মাষ্টার নেজাম উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারগামী পর্যটক এক্সপ্রেস দেরিতে ছেড়ে আসায় জান আলী হাটে স্টেশনে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা প্রবাল এক্সপ্রেসের সাথে ক্রসিং করতে হয়েছে। ১৭ বগি থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি। এর বেশি হলে ক্রসিং করা সম্ভব হতো না। সাধারণত সঠিক সময়ে ছেড়ে আসলে দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশনে ক্রসিং হয়েছে তা জানা যায়নি












