স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ” দৈনিক আজাদীর” সহ-সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক মো. নিযাম উদ্দিন, সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর আজাদী পত্রিকায় নিজেকে সততার সাথে সম্পৃক্ত রেখে জাতির বিবেকের দর্পণ সাংবাদিক নামক মহান পেশায় কাজ করে অবশেষে ৪০ বছর পর তার প্রিয় কর্মস্থল আজাদী পরিবার থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ২১ ইং সোমবার বিদায় নেন।
নিযাম উদ্দিন হালিশহর দরবেশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর হালিশহর মেহের আফজল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে এসএসসি, ১৯৮০ সালে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পরেই আজাদী পত্রিকায় যোগদান করেন। কর্মস্থলে কাজ করার পাশাপাশি ১৯৮৭ সালে এমইএস কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন।
২৬ মে ১৯৬১ সালে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে গুণী সাংবাদিক নিযাম উদ্দিনের জন্ম। দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের দরফ আলী টেন্ডল বাড়ির মরহুম আলহাজ্ব ফকির আহমদের চতুর্থ পুত্র।
ছোট থেকে বড় হয়ে উঠা এই মানুষটি সদালাপী ,নির্লোভ ,নিরহংকারী ,সাদা মনের মানুষ।
গর্বের সাথে আজাদীর সাইনবোর্ড বুকে ঝুলিয়ে এক অসাধারণ পথ পাড়ি দিয়েছেন।
কর্তৃপক্ষ এবং সহকর্মীদের অবাক করে দিয়ে হঠাৎ বলে দিলেন, আর থাকছেন না তিনি তাঁর কর্মস্থলে। কর্তৃপক্ষের অনুরোধও তাঁকে ফেরাতে পারেনি। তিনি বিনীতভাবে না বলেছেন। তাঁর চার দশকের কর্মে দৈনিক আজাদী কর্তৃপক্ষ পরিপূর্ণ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায়।
চট্টগ্রামের সাংবাদিক অঙ্গনেও বেশ সুনাম রয়েছে। সাংবাদিক মহলে সবার প্রিয় মুখ নিযাম ভাই। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবাইকে কাছে টানে। সবাইকে আপন করে নেয়ার এক সহজাত অসাধারণ ক্ষমতাও রয়েছে তাঁর।
৪০ বছরের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের সাংবাদিকতা পেশায় অসামান্য অবদান রেখেছেন পুরো নগর সহ তাঁর নিজ এলাকায়।
নিজেকে কোনদিন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন না প্রচার বিমুখ ও ছিলেন এই প্রবীণ সাংবাদিক।
প্রবীণ এই সাংবাদিক কে নিয়ে আজাদীর সিনিয়র চিফ রিপোর্টার তার সহকর্মী হাসান আকবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিজ ভেরিফাইড ফেসবুকে যেভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন ।
নিযাম ভাইয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কিছুই আজ আর মনে নেই। মনে নেই প্রথম কবে দেখেছিলাম অতি নিরীহ এই ভদ্রলোককে।তবে একথা বেশ মনে আছে যে-আমাদের পরিচয় হয়েছিল তেত্রিশ বছর আগে। তেত্রিশ বছর!!! একই সাথে, একই প্রতিষ্ঠানে!!! অবশ্য নিযাম ভাই শুরু করেছিলেন আরো বছর সাতেক আগে। চল্লিশ বছর টানা একই প্রতিষ্ঠানে!!সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নজিরবিহীন না হলেও বেশ বিরল বটে!!
আমি শুরু করেছিলাম মফস্বল প্রতিনিধি হিসেবে।গায়ে মফস্বলের কাদা মাটির গন্ধ থাকা এই আমাকে কোনদিনই অবজ্ঞা করেন নি তিনি। প্রাণ খুলে কথা বলতেন, খবরাখবর নিতেন। রিপোর্টও দেখে দিতেন, ছাপাতেন।
হাতে লিখা প্রচুর নিউজ নিয়ে দুয়েকদিন পরপরই আমি ছুটে আসতাম অফিসে।ঢাউশ সাইজের ডেক্সে কাজ করতেন সাব-এডিটরদের অনেকেই। নিযাম ভাইও করতেন। একপাশে চুপচাপ বসে কাজ করতেন তিনি।আমাকে দেখলে হাসতেন, কথা বলতেন।
বছর কয়েক মফস্বলে কাটিয়ে যোগ দিলাম অফিসে। সেই তখন থেকে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করতাম আমরা। কত কত্ত কাজ! কাজের ফাঁকে কত কথা!! দিন যায়, রাত যায়, বাড়তে থাকে ঘনিষ্টতা। বয়সে এবং পেশায় সিনিয়র হলেও কখনো তার ছাপ ছিল না আমাদের সম্পর্কে। অতি প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমরা। কখনো ভগ্নিপতি, কখনো হুজুর, কখনো বদ্দা, কখনো মাফিয়া, কখনোবা ক্যাডার- আহা কত নামে যে মানুষটিকে ডাকা। কিন্তু কখনো কোনদিন এক সেকেন্ডের জন্যও মানুষটিকে মন খারাপ করতে দেখি নি। প্রিয় অপ্রিয় যেভাবেই ডাকি না কেন লোকটি সাড়া দিতেন, হাসতেন। সেই প্রিয় মানুষটি গতকাল আমার এবং আমাদের মন খারাপ করে দিয়ে অবসরে চলে গেলেন। টানা ৪০ বছর সাংবাদিকতা করে বিদায় নিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী থেকে। স্বজন প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে বুকের ভিতরটা বুঝি এভাবে হাহাকার করে!!!!
তার আরেক সহকর্মী দৈনিক আজাদী রিপোর্টার সাংবাদিক ঋত্বিক নয়ন তার ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেছেন।
আর কখনো মানুষটি বলবেন না, ঋত্বিক
তাড়াতাড়ি নিউজ দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। কখনো বলবেন না, হেডিংটা আগে দিয়ে দাও। বলবেন না কখনো আর, বিষয়টা নিয়ে একবার আকবর ভাই আর দাদার (দিবাকর দা) সাথে কথা বলো। নিযাম ভাই, দৈনিক আজাদীর আজকের অবস্থানে আসার পেছনে ৪১ বছর ধরে আপনার কর্মনিষ্ঠা আপনার হয়ে কথা বলবে। ভালো থাকবেন, চেষ্টাটুকু অন্তত করবেন ভালো থাকার
।এভাবেই নিজেদের আবেগ মিশ্রিত ভালোবাসার কথা জানান দিলেন।
গুণী সাংবাদিক নিযাম উদ্দিন বলেন বাবার আদর্শে বড় হয়েছি।ছোটবেলায় বাবা আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, আমি আমার “সাদা কাপড়ে দাগ লাগাতে দেইনি” ( অর্থাৎ অজীবনাদর্শ চরিত্রে কোন কালিমা যুক্ত করেননি ) জীবনে এমন চরিত্র গঠন করবে, জাতি যেন আজীবন তোমাকে সম্মানের সহিত স্মরণ করে । বাবার এই উক্তিটি মাথায় রেখে নিজের জীবনকে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছি। তিনি আরো বলেন, আমার সাংবাদিক হয়ে উঠার পিছনে সবচেয়ে যে মানুষটির বেশি অবদান রয়েছে তিনি হলেন প্রয়াত সাংবাদিক মোহাম্মদ ইউসুফ। আল্লাহ যেন মরহুম কে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।
নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন সাংবাদিক নামক মহান পেশায় ভালো কাজ করলেই জাতি আজীবন তাদের কৃতকর্মের কথা স্মরণ রাখবে।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এমডি মহসিন মুরাদ বলেন, ১৯৮৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম মোমিন রোডের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় আমার আসা-যাওয়া। সম্পর্কে আমার মামা হয় ।এই সাদামাটা মানুষটি দীর্ঘ ৪০ বছর আজাদী পরিবারের সাথে অত্যন্ত সুনামের সহিত কাজ করে গেছেন। হালিশহরের এই কৃতী সন্তান টি সাংবাদিকতা নামক মহান পেশায় কাজ করে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়নি ঠিক কিন্তু সম্মান অর্জনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । আজাদী পরিবার থেকে তার বিদায়লগ্নে আমি নিজেও আবেগ-আপ্লুত হয়েছি আল্লাহ যেন তাকে নেক হায়াত দান করেন।